মাও. মুহিবুর রহমান
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া ইমামবাড়ী
জন্ম ও বংশ-পরিচয়
শায়খুল হাদীস আলহাজ¦ হযরত মাওলানা শায়খ আব্দুল মোমিন রহ. ১৯৩০ সালে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলাধীন ১২নং কালিয়ারভাঙ্গা ইউনিয়নের পুরানগাঁও গ্রামের চৌধুরী বংশে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম আব্দুস সাত্তার। তিনি ওলী প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাঁর মাতার নাম গুল বাহার বিবি। তিনি একজন পরহেজগার গুনবতী মহিলা ছিলেন। তিনি তাঁর মাতার একমাত্র সন্তান ছিলেন।
শিক্ষাজীবন
১৯৩৬ সালে স্থানীয় শিবগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জনাব ইব্রাহীম চৌধূরীর কাছে লেখাপড়া করে ১৯৪১ সালে সুনামের সাথে ৫ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করেন। এর পাশাপাশি মক্তবে কুরআন শিক্ষা করেন। এরপর সন্দলপুর বি সি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি হন, সেখানে দুই বছর সুনামের সাথে লেখাপড়া করেন। অতপর তিনি ১৯৪৪ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইমামবাড়ী মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে প্রথম ভর্তিপ্রাপ্ত ৯ জন ছাত্রের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। উক্ত মাদরাসায় নাহবেমীর জামাত পযর্ন্ত অধ্যয়ন করেন। তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হযরত মা. আঃ শহীদ রহ. মাও, ক্বারী মিছবাহুজ্জামান রহ. মাও. মেহদী উজ্জামান রহ. প্রমূখ অতপর বি-বাড়িয়া জামিয়া ইউনূসিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে হেদায়াতুন্নাহু জামাত পযর্ন্ত অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি হবিগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া সাদীয়া রায়ধর মাদরাসায় কাফিয়া জামাত পযর্ন্ত অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে আবার ইমামবাড়ী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে শরহে জামী জামাত পযর্ন্ত সুনামের সাথে সম্পূর্ণ করেন। এরপর একটি স্বপ্নের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের উদ্দ্যেশে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় গমন করেন। সেখানে ৬ বছর সুনামের সাথে লেখাপড়া করেন এবং প্রত্যেক জামাতে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। দেওবন্দে তাঁর সুনামধন্য উস্তাদগনের মধ্যে উল্লোখযোগ্য হলেন: কুতুবুল আলম সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী রহ., আল্লামা ইব্রাহীম মলিয়াবী রহ., আল্লামা সায়্যিদ ফখরুল হাসান রহ., আল্লামা মেরাজুল হক রহ., ক্বারী তৈয়্যব রহ. প্রমূখ।
কর্মজীবন
কর্মজীবনে তিনি ইমামবাড়ী মাদ্রাসায় একটানা ৮ বছর, দিনারপুর বালিধারা মাদ্রাসায় ১ বছর, হবিগঞ্জ উমেদনগর টাইটেল মাদরাসায় ২ বছর, বিশ^নাথ জামিয়া মাদানীয়া মাদ্রাসায় ২ বছর শিক্ষকতার সুমহান পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, অতপর জামিয়া মাদানীয়া নবীগঞ্জ গন্ধা মাদ্রাসায় ৪ বছর মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ইমামবাড়ী মাদ্রাসায় পুনরায় যোগদান করে পর্যায়ক্রমে শিক্ষাসচিব, মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস পদে ১৯৭৪ সাল থেকে ২০১০ সাল পযর্ন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সিলেট শহরতলীর দক্ষিণাঞ্চলে হোসাইনিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদীস হিসেবে ১ বছর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাও. শাহীনুর পাশা চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত “জামিয়া দারুল কুরআন” সিলেটের প্রধান শায়খুল হাদীস হিসেবে হাদীসের র্দস প্রধান করেন। তিনি ইসলাহুল মুসলিমীন হবিগঞ্জ জেলা শাখার সেক্রেটারীর দায়িত্বও পালন করেন। পুরানগাঁও খানক্বায়ে হোসাইনিয়া হাফিজিয়া মাদরাসা ও মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ও জামিয়া মাদানিয়া গন্ধা মিল্লিক মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি নানামূখী দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। তার হাতেগড়া বহু আলেম দেশ-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইলমে দ্বীনের খেদমতে যুগান্তকারী ভুমিকা রেখে যাচ্ছেন। এছাড়া তিনি হবিগঞ্জ দ্বীনি শিক্ষা বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক জীবন
তিনি স্বীয় মুর্শিদ হযরত মাদানী রহ.-এর অনুসরণে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং র্দসে হাদীসের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। ছাত্রজীবনে জমিয়তে তুলাবায়ে আরাবিয়ার সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম হবিগঞ্জ জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অতপর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালের ২৪শে জুন অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে জমিয়তের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালের ২০শে মে জমিয়তের তৎকালীন সভাপতি মাও. আশরাফ আলী শায়খে বিশ^নাথীর ইন্তেকালের পর মাও. মুহিউদ্দীন খান ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর কেন্দীয় কাউন্সিলে শায়খে ইমামবাড়ি কেন্দীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে তিনি পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে জমিয়তের প্রোগ্রামে ইংলেন্ড সফর করেন। তিনি সভাপতি থাকাকালীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কতৃর্ক নিবন্ধিত হয়।
আধ্যাত্মিকতা
১৯৫৬ সালে তাকমীল ফিল হাদীস পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই তিনি ইলমুল ওহীর পাশাপাশি ইলমে তাসাউফের আলো প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে কুতুবুল আলম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর কাছে বায়আত গ্রহণ করেন। এক বছর স্বীয় পীরের খেদমতে তাযকিয়ায়ে কলবে অসাধারণ মেহনতের ফলে ১৯৫৭ সালের মে মাসে পবিত্র রমজান শরীফে আসামের বাশকান্দিতে এতেকাফকালীন সময়ে খেলাফত লাভ করেন। মাদানী রহ. এর শীর্ষ খলিফাগণ বিশেষ করে ফেদায়ে মিল্লাত আল্লামা আসআদ রহ. ও শায়খে কৌড়িয়া রহ. প্রমূখের জীবদ্দশায় তিনি সাধারণত বায়আত করতেন না। কেউ বায়আতের আগ্রহ ব্যক্ত করলে তিনি ফেদায়ে মিল্লাত বা অন্যকারো কাছে বায়আত হওয়ার পরামর্শ দিতেন। ফেদায়ে মিল্লাতের ইন্তিকালের পর হযরত সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানীর নিকট বাংলাদেশী উলামায়ে কেরামসহ ভক্তরা বায়আতের জন্য ভিড় করলে আমাদের শায়খ আব্দুল মোমিন দা. বা. এর কাছে রুজু করার তাগিদ দেন। তখন থেকে শায়খ বায়আত করতে থাকেন। তিনি নিজেকে সব সময় গোপন করে রাখতেন। খেলাফত প্রদানেও তিনি কঠোর ছিলেন। যার ফলে তাঁর খলিফাগণের সংখ্যা অন্যদের থেকে তুলনামূলক কম। ২০১৪ সালে পবিত্র রমজানে পুরো এক মাস ময়মনসিংহে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত খানক্বায়ে হুসাইনিয়া মাদানিয়াতে ইতিকাফ করেন।
পারিবারিক জীবন
পারিবারিক জীবনে তিনি বানিয়াচং উপজেলাধীন আমীরপুর গ্রামের আলহাজ¦ আকছির মিয়ার ১ম কন্যা জায়েদা খাতুনের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি ৬ ছেলে ও ২ কন্যা সন্তানের জনক, তারা হলেন: শহীদ মাওলানা মুফতী আব্দুল্লাহ, মৌলভী উবাইদুল্লাহ, মৌলভী ওলীউল্লাহ, মাও. ক্বারী এমদাদুল্লাহ, মাও. মাহমুদুল হাসান, হা. মাওলানা জুবায়ের আহমদ, সাইয়েদা খাতুন ও হামিদা খাতুন।
মৃত্যু ও দাফন
তিনি ২০২০ সালে ৮ই এপ্রিল রোজ বুধবার রাত ১২ ঘটিকায় নিজ বাড়িতে ইন্তিকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তিনি ৪ ছেলে ২ মেয়ে এবং ছেলে-মেয়েদের ঔরসে ৩৮ জন নাতি- নাতনী ও হাজার হাজার ছাত্র ও ভক্তবৃন্দ রেখে যান। তাঁর জানাযার নামাযের ইমামতি করেন হযরতের সুযোগ্য ছেলে মাও. এমদাদুল্লাহ সাহেব। তাকে নিজ পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। আল্লাহ তা’আলা হযরতের দরজাতকে বুলন্দ করুন। আমীন!